রোহিঙ্গাদের বেপরোয়া ও অপরাধপ্রবণ কর্মকান্ডে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর উদ্বেগ

ডেস্ক রিপোর্ট, কক্সবাজার জার্নাল •

বলপ্রয়োগে বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিক রোহিঙ্গারা অপহরণ,মানবপাচার,মাদক কারবারে সম্পৃক্ত, নিজেদের মধ্যে মারামারি ও দাঙ্গা-হাঙ্গামাসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে আইনশৃঙ্খলার মারাত্মক অবনতি ঘটাচ্ছে।

শনিবার কক্সবাজার র‌্যাব-১৫ এর সদস্যরা টেকনাফের নয়াপাড়া রেজিষ্টার্ড ক্যাম্প সংলগ্ন পাহাড় থেকে সংঘবদ্ধ পুতিয়া গ্রুপের কবল থেকে ৩ জনকে উদ্ধার করে পরিবারের নিকট হস্তান্তর করেছে।

টেকনাফ, উখিয়ার বিভিন্ন ক্যাম্প ও ভাসানচরে আশ্রিত রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে তারা পালিয়ে যাচ্ছে। ছড়িয়ে পড়ছে দেশের বিভিন্ন এলাকায়, যা পুলিশের মধ্যেও উদ্বেগ তৈরি করছে। এ অবস্থায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পরবর্তী করণীয় নির্ধারণের জন্য সভা ডেকেছে বলপ্রয়োগে বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিকদের সমন্বয়, ব্যবস্থাপনা ও আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত জাতীয় কমিটি।

এ বিষয়ে করণীয় নির্ধারণের জন্য বিশেষ সভা ডেকেছে জাতীয় কমিটি।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের নেতৃত্বে সভায় আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদ, শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনের কমিশনার শাহ রেজওয়ান হায়াত, চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি আনোয়ার হোসেন, নোয়াখালী জেলা পুলিশ সুপার মো. শহীদুল ইসলাম, বিজিবি, র‌্যাব, কোস্টগার্ড, কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের প্রতিনিধিসহ কমিটির কর্মকর্তাদের উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, রোহিঙ্গারা ক্যাম্প থেকে পালিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গিয়ে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশিদের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। এসব ঘটনায় অনেকে গ্রেফতারও হয়েছে।

মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যরা বলছেন, রোহিঙ্গারা ক্রমেই বেপরোয়া ও অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল আকার ধারণ করছে।

বিশেষ করে তাদের ক্যাম্প থেকে পালানোর প্রবণতা কোনোভাবেই রোধ করা যাচ্ছে না। কিছুদিন আগে ভাসানচরের আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়ে পালানোর সময় নারী-শিশুসহ ৪০ জন রোহিঙ্গাকে বহনকারী একটি নৌকা সাগরে ডুবে যায়। পরে কোস্টগার্ড তাদের উদ্ধার করে। উদ্ধার হওয়া রোহিঙ্গারা জানিয়েছে, তারা চট্টগ্রাম যাচ্ছিল।

এ ছাড়া ক্যাম্প থেকে পালানো রোহিঙ্গাদের ঢাকা, চট্টগ্রাম, বান্দরবান, কুমিল্লা, পটুয়াখালী, বরিশাল, নোয়াখালীসহ ১১টি জেলা থেকে আটক করা হয়েছে। ২৪ আগস্ট ক্যাম্প থেকে পালিয়ে যাওয়া ৭৪ রোহিঙ্গাকে আটক করা হয় চট্টগ্রামের বোয়ালখালী থেকে। আবার অনেক ক্ষেত্রে স্থানীয় দালালদের মাধ্যমে বিদেশে পাচারের শিকার হচ্ছে রোহিঙ্গারা। এসব ঘটনায় বেশ কয়েকটি মামলাও হয়েছে।

টেকনাফ, মহেশখালী, উখিয়া, চকরিয়া, পেকুয়া ও সেন্টমার্টিন এবং বাঁশখালী থেকে দুই বছরে প্রায় দেড় হাজার রোহিঙ্গাকে উদ্ধার এবং দেড় শতাধিক দালালকে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হয়েছে।

As Violence Soars in Refugee Camps, Rohingya Women Speak Up - SomTribune

পুলিশ জানায়, ভাসানচর ক্যাম্প থেকে প্রায় ৭০০ রোহিঙ্গা বিভিন্ন সময় পালিয়ে গেছে। তাদের মধ্যে ১৩ জন স্বেচ্ছায় ক্যাম্পে ফিরে গেছে। পালানোর সময় সাগরে নৌকা ডুবে মারা গেছে ১৪ জন। এসব ঘটনায় থানায় ১০টি মামলা হয়েছে। মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যরা জানান, আধিপত্য বিস্তার, মাদক ব্যবসাসহ নানা কারণে রোহিঙ্গরা প্রতিনিয়ত নিজেদের মধ্যে মারামারি, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, এমনকি বন্দুকযুদ্ধেও লিপ্ত হচ্ছে।

কিছুদিন আগে কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দুই গ্রুপের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বন্দুকযুদ্ধে বাংলাদেশি এক নাগরিক ও দুই রোহিঙ্গা নিহত হয়। প্রায়শই তাদের মধ্যে গোলাগুলি, হামলা-পাল্টা হামলার ঘটনা ঘটছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগে রোহিঙ্গারা ইয়াবা বহনের কাজ করত। এখন তারা সরাসরি ইয়াবা পাচারে জড়িয়ে পড়েছে। বিশেষ করে উখিয়া ও নাইক্ষ্যংছড়ি এলাকায় ইয়াবার যেসব চালান ধরা পড়ছে, এর বেশির ভাগই রোহিঙ্গাদের।

ইয়াবা পাচারকালে গত দুই বছরে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার বন্দুকযুদ্ধে কমপক্ষে ৩০ জন রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে। এর পরও রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে অনেক ইয়াবা কারবারি গড়ে উঠেছে। তারা ইয়াবা কারবারে মোটা অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগ করেছে। এসব রোহিঙ্গা তিন-চার বছর ধরে ক্যাম্পে থাকার কারণে স্থানীয় ইয়াবা কারবারিদের সঙ্গে তাদের সখ্য তৈরি হয়েছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পভিত্তিক ইয়াবা কারবারিদের আলাদা আলাদা সিন্ডিকেটও তৈরি হয়েছে।

এর মধ্যে কুতুপালং ক্যাম্পে মুন্না, মহিবুল্লাহ ও নজরুল সিন্ডিকেট, বালুখালী ক্যাম্পে জালাল ও জাফর সিন্ডিকেট, পালংখালীতে নবী উল্লাহর নেতৃত্বে আলাদা সিন্ডিকেটের সন্ধান পেয়েছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। এদের সঙ্গে আত্মসমর্পণের পর জামিনে মুক্তি পাওয়া কয়েকজন কারবারির সম্পৃক্ততার তথ্যও পেয়েছে পুলিশ।

এদিকে রোহিঙ্গা অপহরণকারী সংঘবদ্ধ চক্রের সদস্যরা ৩ জনকে গত ২৩ সেপ্টেম্বর কনস্ট্রাকশনের কাজ দেওয়ার প্রলোভন দিয়ে এনে কৌশলে পাহাড়ে নিয়ে ৫লক্ষ টাকা মুক্তিপণ দাবী করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৫ সেপ্টেম্বর দুপুর ১টার দিকে র‌্যাব-১৫ এর একটি দল টেকনাফের নয়াপাড়া রেজিষ্টার্ড ক্যাম্পের আই ব্লক সংলগ্ন পাহাড়ে অভিযান চালায়। এসময় নোয়াখালী হাতিয়ার আফাজিয়া এলাকার মৃত হুমায়নের পুত্র আজিজুল ইসলাম (২৪),ঢাকা নারায়নগঞ্জের আড়াই হাজারের লাকুপোড়া গ্রামের মৃত আশকর আলী সিকদারের পুত্র আল আমিন (৪০) এবং বি-বাড়িয়া সরাইল থানার নোয়াগাও গ্রামের মৃত আব্দুল মোতালেব মৃধার পুত্র মোঃ মোক্তার হোসেন মৃধা (২৭) কে উদ্ধার করে। র‌্যাবের অভিযানকালে অপহরণকারী চক্রের সদস্য আই ব্লকের পুতিয়া গ্রুপের প্রধান ছৈয়দ হোছন প্রকাশ পুতিয়া সহ ১০/১২ জন পালিয়ে যায়।

র‌্যাবের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘আরাকানের বিচ্ছিন্নতাবাদী বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে রোহিঙ্গা ইয়াবা কারবারিদের যোগসাজশ থাকার তথ্যও আমরা পেয়েছি। এসব রোহিঙ্গা ও বিচ্ছিন্নতাবাদীরা দ্রুত অর্থ আয়ের জন্য ইয়াবার কারবারে জড়িয়ে পড়ছে।’

উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আইনশৃঙ্খলার নিয়ন্ত্রণে পুলিশ আন্তরিকভাবে কাজ করছে। এখন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে।

রোহিঙ্গা শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনের (আরআরআরসি) কমিশনার শাহ রেজওয়ান হায়াত  বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প ছেড়ে পালানোসহ বিভিন্ন বিষয়ে কিছু জটিলতা রয়েছে। তবে ক্যাম্পগুলোতে নিজেদের মধ্যে মারামারি ছাড়া অন্যান্য বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক।

বুধবার বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিকদের সমন্বয়, ব্যবস্থাপনা ও আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত জাতীয় কমিটির যে সভা অনুষ্ঠিত হবে, এটি বলতে পারেন আমাদের রুটিন ওয়ার্ক। আমরা তিন মাস পর পর সভা করি।’

Gang violence erupts in Bangladesh Rohingya camps forcing families to flee  | Global development | The Guardian